24613695 ইয়ারমুকের যুদ্ধে সাহাবাদের আত্মত্যাগের নজিরবিহীন ঘটনা

ইয়ারমুকের যুদ্ধে সাহাবাদের আত্মত্যাগের নজিরবিহীন ঘটনা

ধর্ম

ইয়ারমুকের যুদ্ধে সাহাবাদের আত্মত্যাগের নজিরবিহীন ঘটনা

সময়টা ৬৩৬ সালের আগস্ট মাস। ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। যার নাম ইতিহাসে লেখা থাকবে ইয়ারমুকের যুদ্ধ নামে। বলা হয় যে, এই যুদ্ধে মানুষ শুধু কেবল দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন মাথা ও কাটা হাত দেখেছে। এই ইয়ারমুকের প্রান্তরে আত্মত্যাগের এক নজিরবিহীন ঘটনা সংগঠিত হয়েছিল।

ইয়ারমুকের ঐতিহাসিক যুদ্ধে মুসলিমদের সৈন্যবাহিনী ছিল ৪০ হাজার থেকে ৪৫ হাজার। আর রোমানদের ছিল ২ লাখ ৪০ হাজার।
ইয়ারমুকের ঐতিহাসিক যুদ্ধে মুসলিমদের সৈন্যবাহিনী ছিল ৪০ হাজার থেকে ৪৫ হাজার। আর রোমানদের ছিল ২ লাখ ৪০ হাজার।

মুফতি আবদুল্লাহ তামিম

৪ মিনিটে পড়ুন

৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দে হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর খেলাফতকালীন রোমানদের সাথে মুসলিমদের যুদ্ধ হয়। যা বর্তমানে সিরিয়া, জর্ডান ও ইসরায়েলের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া গ্যালিলি সাগরের পূর্বে অবস্থিত ইয়ারমুক নামক নদীর তীরে অবস্থিত।

 
মুসলিমদের সৈন্যবাহিনী ছিল ৪০ হাজার থেকে ৪৫ হাজার। আর রোমানদের ছিল ২ লাখ ৪০ হাজার। একপ্রান্তে ক্ষুদ্র মুসলিম সেনাদল আর অপর প্রান্তে রোমকদের বিশাল সৈন্যবাহিনী। উভয় দলই ভয়াবহ এক যুদ্ধের মুখোমুখি দণ্ডায়মান।
 
 
ঐতিহাসিক এ যুদ্ধে অনেক প্রসিদ্ধ সাহাবি উপস্থিত ছিলেন। হজরত আবু ওবায়দাহ, মুআজ ইবনু জাবাল, আমর ইবনুল আস, হজরত আবু সুফিয়ান,হজর আবু হুরায়রা (রা.)সহ আরো অনেকে। সৈন্যদের মনোবল ধরে রাখতে সেখানে উপস্থিত সাহাবিরা বক্তব্য প্রদান করেন। হজরত আবু ওবায়দাহ (রা.) বলেন,
 

হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পদযুগলকে স্থির রাখবেন। হে মুসলিম সেনাবাহিনী! তোমরা ধৈর্যধারণ কর। কেননা ধৈর্য কুফরি থেকে বাঁচায়, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের এবং লজ্জা নিবারণের উপায়। তোমরা তোমাদের যুদ্ধের সারি থেকে কখনো সরে দাঁড়াবে না। কাফেরদের দিকে এক ধাপও অগ্রসর হবে না এবং আগ বেড়ে তাদের সাথে যুদ্ধের সূচনাও করবে না। শত্রুদের দিকে বর্শা তাক করে থাকবে এবং বর্ম দিয়ে আত্মরক্ষা করবে। তোমাদেরকে যুদ্ধের নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তোমরা মনে মনে আল্লাহর যিকির করতে থাকবে।

 

তারপরই হজরত আমর ইবনুল আস (রা.) বলেন, ‘হে মুসলিমগণ! আপনাদের দৃষ্টি সংযত করুন, চোয়াল শক্ত করে দাঁড়ান। বর্শা দিয়ে শত্রুদের সঙ্গে লড়াই শুরু করুন। তারা তোমাদের তলোয়ারের নাগালের মধ্যে আসলে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ুন, যেভাবে কোন সিংহ তার শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।’
 
হজরত আবু সুফিয়ান (রা.) বলেন,
 

হে মুসলিম জাতি! আপনারা যা দেখছেন সেটাই আমাদের বর্তমান বাস্তবতা। মনে রাখবেন, আপনাদের সামনে আল্লাহর রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং আপনাদের পিছনে শয়তান ও জাহান্নাম।

 

অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য শুনার পর নির্দেশমত যুদ্ধ শুরু হল। প্রচণ্ড আকার ধারণ করল যুদ্ধ। যুদ্ধের একটি পর্যায়ে এসে হুযায়ফা (রা.) আহতদের মধ্যে তার চাচাতো ভাইকে খুঁজতে শুরু করলেন। তার সাথে ছিল সামান্য পানি। হুযায়ফা (রা.)-এর চাচাতো ভাইয়ের শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছিল। তার অবস্থা ছিল আশঙ্কাজনক। হুযায়ফা (রা.) তাকে বললেন,
 
‘তুমি কি পানি পান করবে’? সে তার কথার কোনো উত্তর দিতে সক্ষম না হওয়ায় ‘হ্যাঁ’ সূচক ইঙ্গিত করল। আহত ব্যক্তি হুযায়ফা (রা.)-এর কাছ থেকে পানি পান করার জন্য হাতে নিতেই তার পাশে এক সৈনিককে ‘পানি পানি’ বলে চিৎকার করতে শুনল। পিপাসার্ত ঐ সৈনিকের বুকফাটা আর্তনাদ শুনে তার পূর্বে তাকে পানি করানোর জন্য হুযায়ফা (রা.)-কে ইঙ্গিত দিলেন। হজরত হুযায়ফা (রা.) তার কাছে গিয়ে বললেন,
 

 সেও মারা গেছে। অতঃপর চাচাতো ভাইয়ের কাছে ফিরে আসলে দেখেন তিনিও শাহাদাতের অমিয় শুধা পান করে জান্নাতবাসী হয়েছেন’ (ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১১-১২; সিরাতে আবি বকর সিদ্দিক, পৃ. ২৬৮)।

আপনি কি পানি পান করতে চান’? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তিনি পানি পান করার জন্য পাত্র উপরে তুলে ধরতেই পানির জন্য পার্শ্বের অন্য একজন সৈনিকের চিৎকার শুনতে পেলেন। তিনি পানি পান না করে হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বললেন, ‘তাঁর দিকে দ্রুত ছুটে যাও এবং সে পানি পান করার পর কিছু অবশিষ্ট থাকলে আমাকে দিয়ো’। হুযায়ফা (রা.) আহত সৈন্যটির কাছে গিয়ে দেখলেন, সে মারা গেছে। এরপর দ্বিতীয়জনের কাছে ফিরে এসে দেখলেন

 

 
পানির পাত্রটি তখনও হুযায়ফা (রা.)-এর হাতে। এতটুকু পানি। অথচ তা পান করার মত এখন আর কেউ বেঁচে নেই। যাদের পানির প্রয়োজন ছিল তারা আরেকজনের পানির পিপাসা মেটাবার জন্য এতই পাগলপারা ছিলেন যে, অবশেষে কেউই সে পানি পান করতে পারেননি। অথচ সবারই প্রাণ ছিলো ওষ্ঠাগত। সুবহানাল্লাহ।
 
 
ইয়ারমুকের যুদ্ধে সাহাবাদের আত্মত্যাগের নজিরবিহীন ঘটনায় মুসলিমদের জন্য রয়েছে অনেক অনেক শিক্ষা। স্বার্থপরতার এ যুগে অন্য মুসলিমকে প্রাধান্য দিতেই নবী ও সাহাবারা আমাদের অনেক কিছু নিজেদের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে দেখাতে চেয়েছেন। অথচ আমরা এমন এক সময় অতিবাহিত করছি, যখন মানুষ নিজের স্বার্থের প্রতি অন্ধ আর অন্যের প্রতি থাকে বেখবর।
 
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেছেন, তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই পছন্দ করবে, যা নিজের জন্য পছন্দ করে। (সহিহ বুখারি: ১২)
 
নিজের মনের মধ্যে সংকির্ণতা আর কার্পণ্যতা থাকলে অন্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া অসম্ভব একটি ব্যাপার। রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান আল্লাহর কাছে সর্বদা কৃপণতা থেকে আশ্রয় চাইতেন। (আবু দাউদ: ১৫৪০)। তিনি বলতেন, মুমিন কখনো কৃপণ হতে পারে না। 
 
 

0 Comments